Рет қаралды 336
পুরো নাম উৎপলরঞ্জন দত্ত। জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ, অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। পাশ্চাত্য শিক্ষার আবহে কেটেছিল তাঁর ছেলেবেলা। ১৯৩৯ সালে বাবা গিরিজাশঙ্করের সঙ্গে বদলি হয়ে কলকাতায় আসার পরই উৎপলের পেশাদার থিয়েটার দেখার সূত্রপাত। তিনি লিখছেন, “সেইসব মহৎ কারবার দেখে মনে হল, আমার পক্ষে অভিনেতা ছাড়া আর কিছুই হবার নেই। আমার বয়স তখন তেরো।” উৎপল ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। এই স্কুল ও কলেজ জীবনই তাঁকে ভবিষ্যতের সফল নট-নাট্যকার হিসাবে গড়ে তুলেছিল। ১৯৪৭ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে সহপাঠীদের নিয়ে তিনি তৈরি করেন তাঁর প্রথম নাট্যদল ‘দ্য অ্যামেচার শেক্সপিরিয়ানস’।
বিশ্বব্যাপী গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৫০ সালে দলের নাম বদলে করেন ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। যোগ দেয় রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারা। গণনাট্য সংঘেও যোগ দেন তিনি। গণনাট্যই তাঁকে দিয়েছিল সামাজিক দায়বদ্ধতার পাঠ। দেশের ‘সর্বহারা’ মানুষজনের দুঃখ-দুর্দশার কথাই হয়ে উঠেছিল তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু। এই বোধই ভবিষ্যতে পূর্ণতা পায় তাঁর রচিত-পরিচালিত ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’-এর মতো একের পর এক নাটকে।
’৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহ ও তৎকালীন রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ১৯৬৫ সালে তাঁর নাটক ‘কল্লোল’ যে গণজাগরণ সৃষ্টি করে, তা আজও নজিরবিহীন। নাটকের বিরুদ্ধে নেমে আসে সরকারি কোপ, বিজ্ঞাপন ছাপা বন্ধ করে প্রায় সব সংবাদপত্র। ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার হন উৎপল। সাত মাস পর জেলমুক্তি ঘটলে আয়োজিত হয়েছিল ‘কল্লোল বিজয় উৎসব’। রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে অন্যধারার পেশাদার থিয়েটারে ইতি ঘটিয়ে এল টি জি ও মিনার্ভা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিবেক নাট্যসমাজ’, যা ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’ বা ‘পি এল টি’ নামে পরিচিত হয়।
১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর অভিনীত হয় প্রথম নাটক ‘টিনের তলোয়ার’। রাজনৈতিক নাটকে শ্রেণি, ইতিহাস ও মধ্যবিত্ত সমাজচেতনার এক অপূর্ব মিশেল তাঁকে অন্যভাবে পরিচিত করে তোলে নাটকের অঙ্গনে। প্রযোজনা করেন ‘সূর্যশিকার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘টোটা’, ‘তিতুমীর’, ‘স্তালিন ১৯৩৪’, ‘লালদুর্গ’, ‘জনতার আফিম’-এর মতো বহু কালজয়ী নাটক। শুধু চার দেওয়ালের থিয়েটারেই আটকে থাকেননি, গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে পা রাখেন যাত্রামঞ্চেও। ‘রাইফেল’ পালায় পেশাদার পালাকার ও পরিচালক হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। দীর্ঘ দু’দশক ধরে বহু যাত্রাপালা ও পথনাটকে অভিনেতা-পরিচালক হিসাবে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। মধু বসুর ‘মাইকেল’ ছবির মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা। অভিনয় করেছেন অজয় কর, তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকদের অসংখ্য ছবিতে।
মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ তাঁকে চলচ্চিত্রাভিনেতা হিসাবে জাতীয় পুরস্কার এনে দেয়। সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্য’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ঋত্বিক ঘটকের, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিতে তাঁর অভিনয় বাংলা সিনেমার সম্পদ। উৎপল-প্রতিভায় মুগ্ধ সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘উৎপল যদি রাজি না হত, তবে হয়তো আমি ‘আগন্তুক’ বানাতামই না।’ অভিনয় ছাড়াও ‘ঝড়’, ‘বৈশাখী মেঘ’, ‘ঘুম ভাঙার গান’-এর মতো কয়েকটি চলচ্চিত্র পরিচালনাও করেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন ‘এপিক থিয়েটার’ পত্রিকা। আর এভাবেই বহুমুখী শিল্পকর্ম নিয়ে ভারত তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র ও মঞ্চের ইতিহাসে উৎপল দত্ত চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের মাধ্যমে!