Рет қаралды 344
২০০৬ সালে বিবিসির বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে নিয়েছিল তাঁর ‘মানুষ মানুষের জন্যে’ গানটি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় তাঁর কথা বলতে গিয়ে লিখছেন, ‘আমার মতে, ওঁর কোনও সীমারেখা নেই। ও আজ শুধু বাংলা বা আসামের না, এমনকি সারা ভারতবর্ষেরও নয়, বরং সারা পৃথিবীর!’ তিনি নিজেও দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি গঙ্গার থেকে মিসিসিপি হয়ে ভলগার রূপ দেখেছি’। তিনি ‘ব্রহ্মপুত্রের চারণ কবি’ সুধাকণ্ঠ ভূপেন হাজারিকা। অসমীয়া লোক সংগীতের আধারে একের পর এক গান লিখেছেন, সুর করেছেন, যুক্ত হয়েছেন গণনাট্য আন্দোলনে- যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে তাঁর গানে বারবার ফিরে এসেছে নিপীড়িত, প্রান্তিক মানুষজনের কথা। অসমীয়া, বাংলা, হিন্দি - তিন ভাষাতেই সমান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তাঁর গানগুলি।
১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আসামের সদিয়ায় এক শিক্ষক পরিবারে জন্ম ভূপেন হাজারিকার। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই গান লিখে তাতে সুর দিতেন। শিশুশিল্পী হিসাবে ১২ বছর বয়সে ‘ইন্দুমালতী’ নামক এক অসমীয়া চলচ্চিত্রে ‘বিশ্ববিজয়ী নওজোয়ান’ নামে একটি গানের মাধ্যমে তাঁর সংগীত জগতে পদার্পণ। ১৯৪২ সালে গুয়াহাটির কটন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর, কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে বিএ এবং ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করে, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশ্যে তিনি পাড়ি দেন মার্কিন মুলুকের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে পড়াকালীনই শিল্পী এবং অ্যাকটিভিস্ট পল রোবসনের সঙ্গে তাঁর আলাপ। রোবসনের ‘ওল্ড ম্যান রিভার’ গানটির অনুসরণেই পরে ভূপেন অসমীয়ায় গাইবেন - ‘বিস্তীর্ণ পাররে’। যে গানে মিসিসিপির জায়গা নেবে বড়ুলাই বা ব্রহ্মপুত্র, আরও পরে তিনি তৈরি করবেন এরই একটি অসামান্য বাংলা ভার্সন, যেখানে উঠে আসবে গঙ্গা তীরবর্তী কৌম বাংলার ভূমিপুত্রদের জীবন যন্ত্রণা আর নিরন্তর লড়াইয়ের গল্প।
আত্মজীবনীতে ভূপেন হাজারিকা লিখছেন, ‘একদিন শুনলাম, পল রোবসন আসবেন। সম্পূর্ণ আমেরিকা তাঁকে বয়কট করেছে। ...নির্ধারিত সময়ে এলেন তিনি… শুনতে পেলাম উদাত্ত কণ্ঠের আহবান, ‘ওল্ড ম্যান রিভার, জাস্ট কিপস্ রোলিং অ্যালং’। অসাধারণ লাগল রোবসনের পরিবেশনা। দেখা করলাম তাঁর সঙ্গে। বললাম, আমি কিন্তু মাঝে মধ্যে এসে আপনাকে বিরক্ত করব। ফিরে এসে বন্ধুদের বললাম, সার্থক হল আমার আমেরিকা দর্শন!’ ভবিষ্যতে রোবসনের আরও গানের ভারতীয়করণ করেন তিনি। দেশে ফিরে কিছুদিন গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে চলে আসেন কলকাতায় এবং চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। পাশাপাশি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেতা হিসাবে গণনাট্যের কাজও করতে থাকেন। এই সাংগীতিক-রাজনৈতিক চেতনাই তাঁর গানে বারবার ফিরে ফিরে আসে শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বররূপে।
ভূপেনের দরাজ গলায় ‘বিস্তীর্ণ দু’পারে’, ‘আমি এক যাযাবর’, ‘মানুষ মানুষের জন্যে’, ‘সাগর সঙ্গমে’, ‘প্রতিধ্বনি শুনি’ গানগুলি ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষেরও মন জয় করে নেয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর গাওয়া ‘জয় জয় নবজাতক বাংলাদেশ, জয় জয় মুক্তি বাহিনী’ সাম্যবাদের আশা জুগিয়েছিল সে দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে। অসংখ্য গান, অ্যালবাম এবং ছবিতে সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি লিখেছেন কবিতা, নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র, অভিনয়ও করেছেন একটি ছবিতে। ১৯৭৫ সালে ‘চামেলী মেমসাহেব’ ছবির সুরকার ও সংগীত শিল্পী হিসাবে জাতীয় পুরস্কার পান তিনি, ১৯৯২ সালে পান ‘দাদাসাহেব ফালকে’। এছাড়া, ভারতীয় চলচ্চিত্র ও সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৭ সালে ভারত সরকারের পদ্মশ্রী, ২০০১ সালে পদ্মভূষণ এবং ২০১৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান মরণোত্তর ভারতরত্নে ভূষিত হন ভূপেন হাজারিকা। একের পর এক অসামান্য গান তিনি উপহার দিয়েছেন আপামর ভারতবাসীকে, বহু ভাষায় অনূদিত ও রেকর্ড হয়েছে তাঁর গান। আজ সভ্যতার এই চরম সংকটকালে দাঁড়িয়ে তাঁর সঙ্গীত, তাঁর কণ্ঠস্বরই হয়ে উঠতে পারে আমাদের পাথেয়। জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
#birthdaytribute #bhupenhazarika #indiansinger #indiancinema