Рет қаралды 46,524
বিস্তারিত তথ্য:-
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যের এই নক্ষত্রের আদিপুরুষ ও স্বজনরা ছড়িয়ে আছে খুলনা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। রবি ঠাকুরের পূর্বপুরুষের আদি নিবাস খুলনার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ নামক গ্রামে। একথা ১৯৫২ সালের আগে কারও জানা ছিল না।এই পিঠাভোগ নামক গ্রামটি ঘাটভোগ ইউনিয়নভূক্ত। নওয়াপায়া বিশ্ব রোড থেকে ৭ কি. মি. দক্ষিণে কাজদিয়া সেতু পার হয়ে ১ কি.মি. পূর্বে ভৈরব নদের ৪শ’ ফুট উত্তরে কবিগুরুর পূর্বপুরুষের বসতভিটে পিঠাভোগের কুশারীবাড়িতে। কুশারীরা ছিলেন ব্রাহ্মণ। তাদেরকে পীরালী ঠাকুর বলা হতো। কুশারীদের একাংশ এখনও পিঠাভোগ গ্রামে বসবাস করছে। বিশ্বকবির পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর জমিদারির প্রয়োজনে হোক আর রক্তের টানেই হোক পিঠাভোগের কুশারীবাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখতেন। পিঠাভোগ রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের কারুকার্যময় সুদৃশ্য দ্বিতল ভবনের ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অস্তিত্ব ছিল।
ঐতিহাসিক যোগসূত্র থেকে পিঠাভোগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষ কুশারীদের আর্বিভাব ও গোড়াপত্তন এবং প্রাচীন আদিবসতি বিন্যাসের চিত্র থেকে গ্রামটির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে তথ্য মেলে। খ্রি. অষ্টম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে আদিশুরের রাজস্বকারে বৌদ্ধ প্রভাবাচ্ছন্ন বঙ্গদেশে হিন্দু ধর্মের বিশুদ্ধতা ফিরিয়া আনতে এ প্রাধান্য বিস্তারের অভিপ্রায়ে কান্যকুঞ্জ থেকে যে পঞ্চ ব্রাহ্মণের আবির্ভাব ঘটে তাদের মধ্যে শাল্ল্যি গোত্রীর ক্ষিতিশ ছিলেন অন্যতম। পিঠাভোগের কুশারীরা ও শাল্ল্যি গোত্রীয় ক্ষিতিশের বংশজাত ব্রাহ্মণের ধারাবাহিক উত্তর পুরুষ। কথিত রয়েছে ভট্ট নারায়ণের পুত্র দ্বীননাথ শাল্ল্যি গোত্রীয় শ্রেণীয় ব্রাহ্মণ মহারাজ্য ক্ষিতিশুরের অনুগ্রহে বর্ধমান জেলার ‘কুশ’ নামক গ্রামে দানস্বত্ব লাভ করে কুশারী গোত্রভুক্ত হন (বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণ কাণ্ড, পৃ. ১২১) সেখান থেকে রবী ঠাকুরের পূর্ব পুরুষের উপাধি কুশারী উদ্ভব হয়।
ঐতিহাসিক তথ্য সূত্র অনুযায়ী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশধরের মধ্যে দ্বীননাথ কুশারীর অষ্টম পুরুষ তারানাথ কুশারী, ভৈরব-তীরবর্তী পিঠাভোগ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তারানাথ কুশারীর দুই পুত্র রামগোপাল ও রামনাথ। রামগোপালের পুত্র জগন্নাথ কুশারীই ছিলেন ঠাকুর বংশের আদি পুরুষ। যিনি খুলনা জেলার ফুলতলার দক্ষিণডিহি নিবাসী শুকদেব রায়চৌধুরীর এক কন্যাকে বিয়ে করে পীরালি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে ‘বৈবাহিক দোষে’ হয়ে জাতিচ্যুত হন। পরে তিনি দক্ষিণডিহির শ্বশুরালয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপনে বাধ্য হন। জগন্নাথ কুশারীর পরবর্তী বংশধর পঞ্চানন কুশারী। পারিবারিক মতপার্থক্যের কারণে পঞ্চানন কুশারী খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কলকাতা নামক গ্রামের দক্ষিণে আদি গঙ্গার তীরে গোবিন্দপুরে বসতি স্থাপন করেন। যেহেতু তাঁরা ব্রাহ্মণ ছিলেন তাই জেলে, মালো, কৈবর্ত প্রভৃতি নিম্নবর্ণের প্রতিবেশীরা তাঁদের ‘ঠাকুরমশাই’ বলে সম্বোধন করতেন।
এভাবেই মহেশ্বরের পুত্র পঞ্চানন ‘কুশারী’ একসময় হয়ে যান জয়রাম ঠাকুর। পঞ্চানন থেকেই কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা, জোড়াসাঁকো ও কয়লাঘাটার ঠাকুর গোষ্ঠীর উৎপত্তি। পঞ্চানন ঠাকুরের অধস্তন সপ্তম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অপর দিকে মহেশ্বর কুশারীর অপর সন্তান প্রিয়নাথ কুশারী পিঠাভোগ গ্রামে থেকে যান, যাঁর সপ্তদশ ও অষ্টাদশ বংশধর এখনো পিঠাভোগ গ্রামে বসবাস করছেন। ১৯৯৫ সালে সরকার আদি বাড়িটি উদ্ধার করেন। তবে রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের কারুকার্যময় সুদৃশ্য দ্বিতল ভবনটি উদ্ধার সম্ভব হয়নি। কারণ, ১৯৯৪ সালে অভাব অনটনের কারণে কবির বর্তমান বংশধরেরা সেই ভবনটি বিক্রি করে দেয়।
২০১১-১২ অর্থবছরে সাতটি বর্গে পরীক্ষামূলক প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ পরিচালনা করা হয়। বর্তমানে এটি রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা নামে জাতীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
ঐতিহাসিকদের তথ্য সূত্র অনুযায়ী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার স্বজনদের দেখতে কখনো পিঠাভোগ এসেছিলেন কিনা, তার সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য না পাওয়া গেলেও, তিনি যে খুলনায় এসেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে কবে তিনি খুলনায় এসেছিলেন, তার তারিখ নির্ণয় করা শক্ত। কিন্তু তার ক্যাশ বহিতে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ১৫ ভাদ্র শুক্রবার ৩১ আগষ্ট এর হিসাব মোতাবেক জানা যায় ‘শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রবাবু মহাশয়ের খুলনায় যাতায়াতের ব্যয় ১৬ টাকা। এর আগে ১০ ভাদ্র, ১৩ ভাদ্র, ১৬ ভাদ্র ও ১৮ ভাদ্র তারিখে তার একাধিক পত্র লেখার খবর পাওয়া যায়। সুতরাং অনুমান করা যায়, রবীন্দ্রনাথ ১৩ ভাদ্র খুলনায় এসে ১৫ বা ১৬ ভাদ্র কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলেন। তার কয়েকদিন পর ২০ ভাদ্র তিনি রাধাকিশোর মাণিক্যকে লিখেছেন: “সম্প্রতি লোকেন্দ্র পালিতের নিমন্ত্রণে খুলনায় গিয়াছিলাম।”
১৯৫২ সালে কলিকাতার বাঙ্গী নাট্য সংস্থা ‘কুশারী পরিবার নামে’ একটি নাটক মঞ্চস্থ করে। যে নাটকের কাহিনীতে পিঠাভোগের কুশারীদের সমাজপতন পীরালী শাখা ভুক্ত হওয়া এবং তারপরবর্তী কাহিনী উপস্থাপন করা হয়। কুশারীরা রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষ এর তার সাক্ষ্য বহন করে। পিঠাভোগ জগন্নাথ কুশারী অধঃস্থন ঠাকুর পরিবারের রবীন্দ্রনাথ আর কোন বংশের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়। রবী ঠাকুরের পূর্ব পুরুষের বাসভুমি খুলনার রূপসা উপজেলার পিঠভোগ গ্রামের ঐতিহ্যের পটভুমি এ কথায় অবচেতন মনেও স্মরণ করতে হয়। দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে পিঠাভোগের কুশারীর বাড়ি রবী ঠাকুরের আদি সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে খুলনার দৈনিক জন্মভূমি ও দৈনিক ইত্তেফাকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালের মে মাসে।