Рет қаралды 1,009
তাঁর দৃপ্ত সপ্রতিভ গায়কির জাদুতেই আপামর বাঙালির ‘কৃষ্ণকলি’-র সঙ্গে পরিচয়। আবার চিত্রাঙ্গদা, নটীর পূজা, শাপমোচন, চণ্ডালিকা-র মতো যে কোনও আলোচনায় আজও তাঁর কণ্ঠই প্রামাণ্য। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁকে নিয়ে লিখছেন, ‘তাঁরই গানের জোৎস্নাজলে, ভাসাই জীবনখানি... তাই তো তাঁকে শিল্পী বলে, বন্ধু বলে জানি।’ তিনি বাংলা গানের অনন্য শিল্পী সুচিত্রা মিত্র।
১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, একশো বছর আগে আজকের দিনেই জন্মেছিলেন তিনি। বাবা সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, মা সুবর্ণলতা দেবী। ছোট থেকেই বাড়িতে নাচ-গান-অভিনয়ের এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন সুচিত্রা।
বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় শিক্ষিকা অমিতা সেনের কাছে তাঁর রবীন্দ্রগানে হাতেখড়ি। পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধু পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সংগীত সান্নিধ্যও পেয়েছিলেন কিছুদিন।
১৯৪১ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনের সংগীত ভবন থেকে বৃত্তি লাভ করেন তিনি, পরের বছর ম্যাট্রিক দেওয়ার মায়া ত্যাগ করেই পাড়ি জমান শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। সেখানে গান শেখার সুযোগ পান শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর মতো দিকপালদের কাছে। বন্ধু হিসাবে পান কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুন্ধতী দেবী, সেবা মাইতি প্রমুখকে। গান-নাচের পাশাপাশি বাটিকের কাজ, কাঁচা মাটির পট তৈরি, চামড়ার কাজ ইত্যাদি রপ্ত করে পুরোদস্তুর শিল্পী হয়ে ওঠেন সুচিত্রা! ১৯৪৫-এ সংগীত ভবন থেকে ডিপ্লোমা লাভ করেন। সে বছরই প্রকাশিত হয় প্রথম রেকর্ড, রবীন্দ্রসংগীত ‘মরণ রে’ ও ‘হৃদয়ের এ কূল, ও কূল’।
কলকাতায় ফিরে যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। সান্নিধ্য পান জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বিজন ভট্টাচার্য, দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী ও অন্যান্যদের। দেবব্রত বিশ্বাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে কারখানায়, মাঠে-ময়দানে, নানান সমাবেশে দৃপ্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান, গণনাট্যের গান শোনানোর সুযোগ হয় তাঁর।
রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’-র বিস্মৃতির জবাবে সলিল চৌধুরী রচনা করেন ‘সেই মেয়ে’, রেকর্ড করেন সুচিত্রা মিত্র। সে গানও তৈরি করে এক অন্য ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সংস্কৃতির যে প্রেক্ষিত, তার সঙ্গে তিনি অনায়াসে মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ আর অধিকারের সংগ্রামকে। সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে একাকার হয়ে গিয়েছিল রবি ঠাকুরের গান আর গণসংগীতের প্রতিবাদী সুর।
পরবর্তীতে অতুলপ্রসাদী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রভৃতি গাইলেও বারবার তিনি ফিরে গেছেন রবীন্দ্রনাথের কাছেই। প্রায় পাঁচ দশকব্যাপী শিল্পীজীবনে রবীন্দ্রনাথের নানা পর্যায়ের, নানা মেজাজের গান প্রাণ পেয়েছে তাঁর আশ্চর্য সাবলীলতায়। ‘ঝরঝর বরিষে’, ‘রইল বলে রাখলে কারে’, ‘নব কুন্দধবলদল’ ইত্যাদির গায়ন থেকে সুচিত্রা মিত্রকে আলাদা করা যাবে না কোনওদিনই।
গানের পাশাপাশি লিখেছেন পদ্য, যার মধ্যে স্বরচিত ছড়া-কবিতা ছাড়াও আছে ভিনদেশি কবিতার অনুবাদ। লিখেছেন স্মৃতিচারণা, ছোটদের গল্প, রূপকথা, রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তক, গীতি-আলেখ্যের ভাষ্য ইত্যাদিও। দীর্ঘ সময় জুড়ে অধ্যাপনা করেছেন শান্তিনিকেতনে, আবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রবীন্দ্রচেতনা ছড়িয়ে দিতে গড়ে তুলেছেন ‘রবিতীর্থ’।
সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মানও পেয়েছেন নানা মহল থেকে। পদ্মশ্রী, দেশিকোত্তম, আলাউদ্দিন পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি ও আরও কত! সেই সঙ্গে পেয়েছেন অগুনতি মানুষের শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম এবং ভালোবাসা। তাঁর আবক্ষ মূর্তি গড়েছেন রামকিংকর বেইজ। তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন সুব্রত ঘোষ ও রাজা সেন।
উস্তাদ আমজাদ আলি খান বর্ণনা করেছেন ‘রবীন্দ্রসংগীতের এক উজ্জ্বল প্রতীক’ হিসাবে। এভাবেই বাংলা ও বাঙালির মননে সুচিত্রা মিত্র চিরভাস্বর হয়ে আছেন রবীন্দ্রসংগীতের সম্রাজ্ঞী এবং গণসংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ হিসাবে। আজ তাঁর শতবর্ষের এই শুভ মুহূর্তে তাঁর প্রতি আমাদের প্রণতি।
#birthdaytribute #SuchitraMitra #RanbindraSangeetArtist #singer